ইলিশ ধরা বন্ধের তারিখ ২০২২
অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও মা ইলিশ সংরক্ষণ ও জাটকা নিধন ঠেকাতে ২০২২ সালের ইলিশ মাছ ধরা বন্ধের তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়। মন্ত্রনালয় কতৃর্ক ঘোষিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে।
দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ও নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিতকল্পে প্রতি বছর মা মাছ নিধন ঠেকাতে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ হতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
এর আগে জাটকা নিধন ঠেকাতে টানা ৬৫ দিন বন্ধ থাকার পর ২৩ জুলাই হতে ইলিশ মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সমূহের মধ্যে চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী এবং নদী অববাহিকার জেলা বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুরসহ অনেক অঞ্চলের জেলেদের ইলিশ ধরতে দেখা যায়। যদিও স্বাদের দিক থেকে নদীর ইলিশের চাহিদা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং মায়ানমারের জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ে। বাংলাদেশের জেলেদের ভাষ্যমতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর জেলেদের জালে আগের তুলনায় বড় বড় মাছ ধরা পড়ছে। এগুলো যেমন দেখতে সুন্দর ঠিক তেমনই স্বাদেও অনন্য।
যদিও এবছর প্রথম দিকে বা বর্ষা মৌসুমে আশানুরূপ আশানুরূপ মাস জেলেরা পায়নি। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই সময়টায় ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরার কারণে হয়তো বাংলাদেশের উপকূলে ইলিশের আনাগোনা কম ছিল।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান ও জেলেদের সহায়তায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে যা গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বাজারে সরবরাহ বেড়েছে, পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০০১-০২ বছরে যেখানে ইলিশ মাছের উৎপাদন ছিল ২ লক্ষ ২০ হাজার মেট্রিকটন তা ২০২১-২২ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া মাছের প্রজনন বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।
মূলত বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর তিন স্তরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। প্রথমত জাটকা নিধন বন্ধে অভিযান ও মা মাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা, প্রজনন সময়ে বা ডিম পাড়ার সময় মা মাছ ধরা নিষেধ এবং সাগর হতে নদীতে মাছের প্রবেশ নিরাপদ ও নিরবিচ্ছিন্ন করণ। এই তিনটি ধাপ সঠিকভাবে প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনে বছর বছর সুফল পেয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত ইলিশ ধরা বন্ধে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ট্রলারের কোন নিষেধাজ্ঞা করা হলেও পরবর্তী সময়ে সকল ধরনের জেলে ও মাছ ধরা ট্রলার এর উপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
বাংলাদেশের ইলিশ প্রধান ১৭ জেলা যেগুলো মূলতঃ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর কোল ছুঁয়ে অবস্থিত, এসব জেলার জেলেদের মাছ শিকারে মার্চ-এপ্রিল মাসে জাটকা নিধনে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মা মাছ নিধনে বিধিনিষেধ থাকে। ইলিশ প্রধান ১৭ জেলার ৮৫ উপজেলার জেলেরা এই বিধিনিষেধ চলাকালে ১০ ইঞ্চি ছোট মাছ ও ডিম দেওয়ার সময়ে মা মাছ ধরা হতে বিরত থাকে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকতাদের মতে, একেকটি মা ইলিশ প্রতি প্রজনন মৌসুমে প্রায় চার থেকে পাঁচ লক্ষ ডিম দেয়।
আগে বাংলাদেশের ২৪ টি মাত্র উপজেলায় ইলিশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে প্রায় ১২৫ টি উপজেলায় জেলেদের জালে ইলিশ পওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও নদীতে নতুন চর কিংবা দীর্ঘদিন ধরে চর হিসেবে থাকা অঞ্চল ডুবে যাওয়ায় মিঠা পানিতে আসা ইলিশের গতিপথ বদলাতে শুরু করেছে।
বিশ্বের মোট ইলিশের শতকরা ৮৫ ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হলে ইলিশের জেলা চাঁদপুর না বরগুনা তা নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ্ব। কারণ ইলিশ উৎপাদনে বরিশাল বিভাগের ভোলা রয়েছে শীর্ষ অবস্থানে। এদিকে, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরগুনা যেখানে ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুরের অবস্থান ষষ্ঠ। আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।
ইলিশের দাম কোথায় কেমন
তবে, উৎপাদনে শীর্ষে থাকা জেলার তুলনায় ঢাকা ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, জেলেদের সাথে আড়তদারদপর যোগসাজশের ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলেরা আড়তদারদের নিকট অগ্রীম টাকা নিয়ে থাকে যাকে স্থানীয় ভাষায় দাদন দেওয়া বলে। ফলে তারা চাইলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম থাকে।
অপরদিকে, সিন্ডিকেটের কার্যক্রমও এই দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে। কারণ হিসেবে বলা হয় সিন্ডিকেটরা সাগর ও নদীর ইলিশ একত্রিত করে শহরে সরবরাহ করে কম সময়ে লাভবান হয়। মূলতঃ মায়ানমার ও ভারতের অংশের সাগরের ইলিশ স্বাদ দামে কিছুটা নিম্নমানের হওয়ায় বাজার মূল্য অমেক কম। যা বাজারজাতকরণের জন্য শহরাঞ্চল একটি উত্তম জায়গা। কারণ শহরের মানুষ সাগর ও নদীর ইলিশের ব্যতিক্রম সহজে অনুমান করতে পারে না।
নদীর ইলিশ চেনার উপায়
স্বাদের তারতম্য থাকায় নদী ও সাগরের ইলিশের দাম ও মূল্যয়ন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। ভারত ও মিয়ানমারের ইলিশ মূলত সাগরে উৎপাদিত হয় তাই বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার চাহিদা বাংলাদেশের বাহিরেও রয়েছে।
তবে নদীর ইলিশ ও সাগরের ইলিশ চেনার বেশ কিছু উপায় রয়েছে।
ইলিশ মূলতঃ লোনা পানির মাছ যা সাগরের গভীর জলে থাকে। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ডিম দেওয়ার জন্য মিঠা পানি তথা নদীতে প্রবেশ করে। সাগর হতে ইলিশ নদীতে আসার জন্য উজান বা স্রোতের বিপরীতে আসতে হয়। এই সময়ে তাদের শরীরের গঠনগত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়। এই সময়ে শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মাছের স্বাদেও পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন মূলতঃ মাছের খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন হেতু হয়ে থাকে।
ইলিশ সাগরে থাকা কালীন অবস্থায় মূলত সাগরের ছোট ছোট মাছ ভক্ষণ করে থাকে। কিন্তু নদীতে বা মিঠাপানিতে আসবে এই সময় ইলিশ নদীর যে প্ল্যাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায়। ফলে মাছগুলো কিছুটা খর্বাকৃতির হয়ে এবং চওড়া পেট ধারণা করে। খাদ্যাভ্যাস ও পানির পরিবর্তন হেতু মাছের পেটে কিছুটা তেল জমতে শুরু করে। এই ফ্যাট বা তেলই হলো স্বাদের কারণ।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.